ইলেক্ট্রো এনার্জিতে চীনের দাপট !

  



ভবিষ্যত বিশ্ব  নিয়ন্ত্রণে  আগের মতো তেল, মিসাইল বা নিউক্লিয়ার অস্ত্রের উপর  নির্ভর করতে হয় না বরং কে উন্নত ক্রিটিকাল টেকনোলজি তৈরী করবে তার উপর নির্ভর করে। পূর্বে আমরা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক উৎসের ভিত্তিতে বৈশ্বিক প্রতিযোগীতা দেখতাম কিন্ত আজ তা পরিবর্তনের সুর দিচ্ছে। পৃথিবী আজ ইলেক্ট্রো ইকোনমির দিকে ধাবিত হচ্ছে। অর্থাৎ আজ আমরা ডিজেল বা পেট্রোল ব্যবহার করে চলা  গাড়ির  বদলে বিদ্যুতের মাধ্যমে চলা গাড়ির কথা বলছি এবং ব্যবহার ও করছি। ভবিষ্যতে হয়তো সব গাড়ি ই বিদ্যুতের মাধ্যমে চলবে।

তাই বলা যায়, বিশ্ব বাণিজ্য এখন তেলভিত্তিক নয় বরং খনিজ ভিত্তিক হতে চলেছে। এরজন্য দেখা যায় আমেরিকার মতো দেশ আজকাল তাদের মজুদকৃত তেল বিক্রি করে দিচ্ছে অথচ তাদের পলিসি অনুযায়ী এই তেল ভবিষ্যতের জন্য মজুদ করার ই কথা ছিল ! অর্থাৎ প্রেক্ষাপট পাল্টাচ্ছে। পেট্রোল ডিজেল কয়লার জায়গা টাইটেনিয়াম, লিথিয়াম ইত্যাদি গ্রিন এনার্জি গুলো দখল করছে। চীন এই অবস্থা অনেক আগে বুঝেছে বলে এখন তারা এই ইলেক্ট্রো এনার্জি সেক্টরটি প্রায় সম্পূর্ন দখল করে ফেলেছে। তো কি এই ইলেক্ট্রো এনার্জি? চীন কিভাবে এর সরবারহ নিয়ন্ত্রণ করছে ? চলুন জানার চেষ্টা করি।


ইলেক্ট্রো এনার্জিঃ



পর্যায় সারণির গ্রুপ - এফ এর ১৭ টি মৌলকে মূলত ইলেক্ট্রো এনার্জি বলা হয়। এদের বিশেষত্ব হলো এরা খুব সহজে শক্তি সঞ্চয় এবং সহজে বেশি শক্তি ব্যয় না করে শক্তিকে রুপান্তর করতে পারে।  এগুলোকে আবার "Rare Earth" ও বলা হয়। এইখানে Earth বলতে অক্সাইডকে বুঝায়। অর্থাৎ এরা দুর্লভ অক্সাইড । এদেরকে মূলত এদের উৎপাদনের জায়গার উপর ভিত্তি করে দুর্লভ বলা হয়।সহজ ভাষায় এদের পরিমাণ অনেক ই কিন্ত পৃথিবীর সব অঞ্চলে এদের অস্তিত্ব নেই।


চীন কিভাবে এর সরবারহ নিয়ন্ত্রণ করে?

আচ্ছা আপনি কি চীনের একটি গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে পারবেন? বেশিরভাগ মানুষ ই হয়তো উত্তরটি দিতে পারবেন না। কেননা আমরা ছোটবেলা থেকে ফেরারি, ল্যাম্বরগিনি ,ফর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম শুনে এসেছি এবং এখনো তারা রাজত্ব করছে। আসলে চীন ও বুঝতে পেরেছিল যে এইসব পশ্চিমা গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে তারা পেরে উঠবে না।এরজন্য তারা শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়েই তাদের গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল।


চীন ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিল। আজ থেকে প্রায় ১৫/২০ বছর আগে থেকেই তারা দুর্লভ অক্সাইড ও খনিজের মালিকত্ব নেওয়া শুরু করে। কিন্ত আমরা যদি চীনের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে তাদের কাছে এই ধরণের খনিজের পরিমাণ খুবই কম। তো তবুও কিভাবে এই সেক্টরে তারা আধিপত্য বিস্তার করছে?


আচ্ছা ধরেন আপনি মধু বিক্রির ব্যবসা করতে চান। তো বাজার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে যদি আপনি সব মধুচাষীর সাথে চুক্তি করেন তাহলে কি আর ব্যবসায়ী থাকলো? চীন ও ঠিক একই কাজটি করেছে।

বিশ্বের প্রায় ৫৪ শতাংশ লিথিয়াম আর্জেন্টিনা,চিলি ও বলিভিয়ায় পাওয়া যায়। কিন্ত উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেখা যায় অস্ট্রেলিয়া,চিলি ও চীন সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে। এখানে আমরা দেখতে পাই চীনের লিথিয়াম ভান্ডার না থাকলেও তারা উৎপাদন করছে। এর পিছনের কারণ হচ্ছে, চীন- আর্জেন্টিনা,চিলি ও বলিভিয়ায় লিথিয়াম খনন করার জন্য বিনিয়োগ করেছে এবং তা নিজের দেশে এনে গাড়ি,মোবাইলের ব্যাটারি ইত্যাদির জন্য উৎপাদন করছে। এছাড়াও চীন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এগুলো উৎপাদনের জন্য ও বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া,ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে তাদের বিনিয়োগকৃত কারখানা আছে।


আবার কোবাল্টের কথাই ধরা যাক। দেখা যায় পৃথিবীর প্রায় ৬৮ শতাংশ কোবাল্ট কঙ্গোতে পাওয়া যায়। চীন এখানের ১৪ টি বড় বড় মাইনিং কোম্পানির সাথে চুক্তি করে বিনিয়োগ করে প্রায় সম্পূর্ণ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ তাদের দেশে উৎপন্ন কোবাল্টের পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশ !

বিনিয়োগ ছাড়াও তাদের আরেকটি কৌশল হলো Upstream,MidStream ও Downstream এর নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ শুধু মাত্র বিনিয়োগ নয় ব্যাটারির কাঁচামাল অনুসন্ধান করা, তারপর মিডস্ট্রিমে ব্যাটারির জন্য কেমিক্যাল, এনোড ও ক্যাথোড বানানো এবং সর্বশেষ ডাউনস্ট্রিমে ব্যাটারি সেল বানানো। তারা এই কৌশলটির বাস্তবায়ন সম্পূর্ণভাবে নিজ দেশের মধ্যে করছে।


সুতরাং আমরা বলতে পারি চীন পৃথিবীর দুর্লভ খনিজ সরবারহ শৃঙ্খলা প্রায় সম্পূর্ণ দখল করে ফেলেছে। এর মূল কারণ হিসেবে আমরা দুটি কৌশল দেখতে পাই।

  • বিনিয়োগ করা
  • Upstream, Midstram,Downstream এ ও নিয়ন্ত্রণ করা। 

২০১৯ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় চীনে খনিজগুলো না থাকা সত্ত্বেও ৮০ শতাংশ কাঁচামাল তারা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ৭৩ শতাংশ ব্যাটারি সরবারহ চীনের নিয়ন্ত্রণে হচ্ছে।


এই বড় সফলতার পিছনে তাদের ৫ বছরের পরিকল্পনা কাজ করেছে। এই পরিকল্পনায় জাতীয় একশান মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইলেক্ট্রিক গাড়ি বানানোর লক্ষ্য পূরণ করা হয়েছে।
ব্যাটারি চালিত গাড়িগুলোকে বিশেষ রোড এক্সেস,অভ্যন্তরীন কোম্পানিগুলোকে বিশেষ কর ছাড়সহ বিভিন্ন সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

এছাড়াও সাংহাই,বেইজিং এর মতো শহরে ডিজিটাল রিসার্চ ডেভলপমেন্টের জন্য পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে। 
এখন প্রশ্ন আসতে পারে চীন কিভাবে মার্কেট পাচ্ছে? এর উত্তর হচ্ছে

  • বিদেশী কোম্পানির সাথে দেশীয় কোম্পানীর পার্টনারশিপ- চীন তার দেশে বিদেশী কোম্পানির সাথে নিজের দেশের কোম্পানির একত্বকরণ করছে। এতে করে বিদেশী কোম্পানী গুলো সহজে তাদের ইলেক্ট্রিক গাড়ি বা মোবাইলের ব্যাটারি উৎপাদন করছে এবং দেশী কোম্পানিগুলো ও কাস্টমার পাচ্ছে। 

  • ইকোনমিক স্কেল লাভ করা- যখন একটি কোম্পানির উৎপাদন খুব বেশি হয়ে পড়ে তখন সেই কোম্পানির খরচ কমে যায়। চীনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তারা এতো উৎপাদন করেছে যে তাদের খরচ কমার দরুণ তারা খুব স্বল্প মূল্যে পণ্য দিতে পারছে। এতে করে বাজারে আর প্রতিদ্বন্দী থাকে না । তাই অন্যদেশ সমূহ চীনের সাথে পেরে উঠছে না।


চীন ২০২০ সালে প্রায় ৫০ লাখ ইলেক্ট্রিক গাড়ি বানিয়েছে যা পৃথিবীর ৫০ ভাগ । এছাড়াও ভারী ইলেক্ট্রিক যানবাহনের প্রায় ৯০ ভাগ ই চীনে তৈরি। উক্ত পদ্ধতিতেই  চীন তাদের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অক্ষমতাকে উপলব্ধি করে অন্য  একটি সেক্টরে ভবিষ্যত দেখে সাফল্যের সাথে একক আধিপত্য কায়েম করেছে।



Post a Comment

0 Comments